টিউমার কেন হয়: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধের সহজ উপায়

 

টিউমার

টিউমার হলো শরীরের কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত কোষ তৈরি হয় এবং পুরোনো কোষ ধ্বংস হয়। কিন্তু কখনো কখনো এই প্রক্রিয়া ঠিকমতো কাজ করে না। তখন শরীরে অতিরিক্ত কোষ তৈরি হয়, যা একত্রিত হয়ে টিউমার তৈরি করে।


টিউমার কী?

টিউমার হল একটি মাংসপিণ্ড বা পিণ্ডের মতো, যা শরীরে বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হতে পারে। এটি হতে পারে ভালো (সৌম্য) বা খারাপ (অসৌম্য)। সৌম্য টিউমার ক্ষতিকারক নয় এবং সাধারণত শরীরের অন্য কোথাও ছড়ায় না। কিন্তু অসৌম্য টিউমার, যাকে ক্যানসারও বলা হয়, তা বিপজ্জনক হতে পারে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।


টিউমার কেন হয়?

টিউমার হওয়ার বিভিন্ন কারণ আছে। কিছু কারণ সরাসরি বোঝা যায়, আবার কিছু কারণ অজানা। নিচে টিউমার হওয়ার কিছু সাধারণ কারণ উল্লেখ করা হলো।

১. জেনেটিক বা বংশগত কারণ

অনেক সময় টিউমার হওয়ার প্রবণতা বংশগত হয়। যদি পরিবারের কারো টিউমার বা ক্যানসার হয়ে থাকে, তাহলে অন্য সদস্যদেরও টিউমার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। জেনেটিক মিউটেশন (জিনের পরিবর্তন) অনেক সময় এই প্রবণতা বাড়ায়।

২. কোষ বিভাজনের সমস্যা

আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত নতুন কোষ তৈরি হয়। এই কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় কোনো ভুল হলে টিউমার হতে পারে। যখন নতুন কোষের সংখ্যা বেশি হয় এবং পুরোনো কোষ ঠিকমতো ধ্বংস হয় না, তখন শরীরে অপ্রয়োজনীয় কোষ জমা হতে শুরু করে। এভাবে টিউমার তৈরি হয়।

৩. কেমিক্যাল এবং টক্সিন

কিছু রাসায়নিক এবং বিষাক্ত পদার্থ শরীরে প্রবেশ করলে কোষের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট করে দিতে পারে। ধূমপান, তামাক, এবং দূষিত বাতাসে থাকা কিছু কেমিক্যাল টিউমার সৃষ্টির অন্যতম কারণ। এগুলো কোষের ডিএনএ-কে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যা পরে টিউমারে রূপান্তরিত হয়।

৪. ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া

কিছু ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া শরীরে টিউমার সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV) মহিলাদের সার্ভিকাল ক্যানসারের অন্যতম কারণ। হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস লিভার টিউমারের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া কিছু ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণও টিউমারের জন্য দায়ী হতে পারে।

৫. হরমোনের সমস্যা

কিছু সময় হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে টিউমার হতে পারে। বিশেষ করে মহিলাদের স্তন, জরায়ু এবং ডিম্বাশয়ে হরমোনের প্রভাব বেশি পড়ে। যদি শরীরে হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায় বা কমে যায়, তবে টিউমার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

৬. খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রা

খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রার প্রভাবও টিউমার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। যেসব মানুষ বেশি চর্বি, প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং কম ফলমূল খান, তাদের টিউমার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম না করা, অতিরিক্ত মদ্যপান এবং স্থূলতাও টিউমার সৃষ্টির ঝুঁকি বাড়ায়।

৭. সূর্যালোক এবং রেডিয়েশন

অতিরিক্ত সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মি ত্বকের কোষের ডিএনএকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যা ত্বকের টিউমার বা মেলানোমা সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া, কিছু রেডিয়েশন, যেমন এক্স-রে বা পরমাণু শক্তি থেকে নির্গত রশ্মি, শরীরের কোষের ক্ষতি করে এবং টিউমার সৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ায়।


টিউমারের ধরন

টিউমার সাধারণত দুই ধরনের হতে পারে: সৌম্য (Benign) এবং অসৌম্য (Malignant)।

১. সৌম্য টিউমার

সৌম্য টিউমার সাধারণত ক্ষতিকারক নয়। এটি শরীরের অন্য কোথাও ছড়ায় না এবং প্রায়ই অস্ত্রোপচার করে সরিয়ে ফেলা যায়। যদিও এটি বড় আকার ধারণ করতে পারে, তবে এটি সাধারণত ক্যানসারে পরিণত হয় না।

২. অসৌম্য টিউমার

অসৌম্য টিউমার বিপজ্জনক। এটি দ্রুত শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই ধরনের টিউমারকে ক্যানসার বলা হয়। যদি এটি সময়মতো চিকিৎসা না করা হয়, তবে এটি প্রাণঘাতী হতে পারে।


টিউমারের লক্ষণ

টিউমার হলে শরীরে কিছু লক্ষণ দেখা যেতে পারে। যেমন:

  • শরীরে কোনো অস্বাভাবিক পিণ্ড বা ফোলাভাব।
  • দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, বিশেষ করে শরীরের নির্দিষ্ট অংশে।
  • দ্রুত ওজন হ্রাস বা বৃদ্ধি।
  • খাবারে অনীহা এবং দুর্বলতা।
  • কোনো ক্ষত বা ঘা যা দীর্ঘদিনেও সারে না।

টিউমারের চিকিৎসা

টিউমার চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন উপায় রয়েছে। চিকিৎসার ধরন নির্ভর করে টিউমারের ধরণ, আকার, এবং অবস্থানের ওপর। নিচে কিছু সাধারণ চিকিৎসার পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো:

১. অস্ত্রোপচার

টিউমার যদি শরীরের কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় থাকে এবং তা সহজেই সরানো সম্ভব হয়, তবে অস্ত্রোপচার একটি কার্যকর পদ্ধতি। এর মাধ্যমে টিউমার সম্পূর্ণভাবে কেটে ফেলা হয়।

২. কেমোথেরাপি

কেমোথেরাপি হলো একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে ওষুধ ব্যবহার করে টিউমারের কোষ ধ্বংস করা হয়। এটি সাধারণত ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। তবে এই চিকিৎসার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে, যেমন চুল পড়া, দুর্বলতা এবং বমি।

৩. রেডিয়েশন থেরাপি

রেডিয়েশন থেরাপির মাধ্যমে টিউমার কোষকে ধ্বংস করার জন্য উচ্চমাত্রার রশ্মি ব্যবহার করা হয়। এটি টিউমারের আকার ছোট করতে সাহায্য করে এবং অনেক সময় টিউমার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়।

৪. ইমিউনোথেরাপি

এই পদ্ধতিতে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে টিউমারের বিরুদ্ধে লড়াই করা হয়। এটি একটি নতুন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি, যা কিছু ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।


টিউমার প্রতিরোধের উপায়

টিউমার প্রতিরোধ করার জন্য কিছু সাধারণ অভ্যাস মেনে চলা যায়:

  • সুষম খাবার খাওয়া: বেশি পরিমাণে ফলমূল এবং শাকসবজি খাওয়া শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
  • নিয়মিত ব্যায়াম: শরীরকে সক্রিয় রাখা এবং অতিরিক্ত ওজন এড়ানো টিউমার প্রতিরোধে সহায়ক।
  • ধূমপান এবং মদ্যপান থেকে বিরত থাকা: এই দুটি অভ্যাস টিউমার সৃষ্টির ঝুঁকি বাড়ায়, তাই এগুলো এড়ানো উচিত।
  • সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা পাওয়া: ত্বকের টিউমার প্রতিরোধের জন্য সানস্ক্রিন ব্যবহার এবং সূর্যের আলো থেকে সুরক্ষিত থাকা জরুরি।

শেষকথা:

টিউমার হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে, যেমন জেনেটিক প্রভাব, কোষ বিভাজনের সমস্যা, কেমিক্যাল, ভাইরাস, এবং জীবনযাত্রার অভ্যাস। সৌম্য টিউমার ক্ষতিকারক না হলেও অসৌম্য টিউমার বিপজ্জনক এবং ক্যানসারের ঝুঁকি তৈরি করে। তবে, সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে টিউমার থেকে সুস্থ হওয়া সম্ভব। টিউমার প্রতিরোধে সুস্থ জীবনযাত্রা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url