জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ, কারণ, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের উপায়
কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, বেজি, বাদুড়, বানর ইত্যাদি যে কোনো মাংসাশী প্রাণী জলাতঙ্ক সৃষ্টিকারী ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এবং আক্রান্ত প্রাণীটি সুস্থ মানুষ বা গবাদিপশুকে কামড়ালে ওই মানুষ কিংবা গবাদিপশুও এ রোগে আক্রান্ত হয়। তবে আমাদের দেশে ৯৫ শতাংশ জলাতঙ্ক রোগ কুকুরের কামড়ে হয় তাছাড়াআক্রান্ত প্রাণীর মুখের লালায় জলাতঙ্কের ভাইরাস থাকে,এই লালা সুস্থ ব্যক্তির শরীরে পুরোনো ক্ষতের বা দাঁত বসিয়ে দেওয়া ক্ষতের মাধ্যমে কিংবা সামান্য আঁচড়ের মাধ্যমে রক্তের সংস্পর্শে এলেই জলাতঙ্ক হবে।
এই পোস্টে যে বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে:
- কি কি কারণে জলাতঙ্ক হয়?
- জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ গুলো কি কি?
- জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ কত দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়?
- জলাতঙ্ক কি ছোঁয়াচে রোগ?
- জলাতঙ্ক কি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়?
- জলাতঙ্ক রোগের টিকা:
- বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ:
- কুকুরের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ:
- ছাগলের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ:
- কুকুর বিড়াল, গরু, ছাগলের জলাতঙ্ক রোগের টিকা (Rabies Vaccine):
কি কি কারনে জলাতঙ্ক হয়?
- জলাতঙ্কে আক্রান্ত প্রাণী কামড় দিলে
- আঁচড় দিলে
- ক্ষত চামড়ায় লেহন (চাটা) দিলে
- দেহের যে কোনো ছিদ্রের ভেতরের চারপাশের নরম অংশ) স্পর্শ দিলে
- বাদুড়ের বিষ্ঠা শ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করে।
- জলাতঙ্কে আক্রান্ত কোনো মানুষের রক্ত নিলে
জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ গুলো কি কি?
জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ গুলো:
- পানি দেখলে ভয় পাওয়া বা আতঙ্কিত হওয়া,
- আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণ অস্বাভাবিকতা দেখা যাবে,
- অস্বাভাবিক কথাবার্তা ও ভাবভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াবে,
- ক্ষুধামান্দ্য, খাওয়া দাওয়ায় অরুচি,
- বিকৃত আওয়াজ করা বা গোঙানো
- কণ্ঠস্বর কর্কশ হয়ে যাওয়া,
- মেজাজ খিটখিটে হওয়া,
- বিনা কারণে অন্যকে আক্রমণ বা কামড় দিতে চাইবে,
- আক্রান্ত ব্যক্তির প্রচণ্ড পানির পিপাসা পেলেও পানি দেখলেই তিনি ভয় পাবেন,
- অন্ধকারে ও মানুষের চোখের আড়ালে একাকী থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন,
- খিঁচুনিসহ মুখ থেকে অতিরিক্ত লালা নিঃসৃত হয়।
- শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়া, ঝিমুনি হওয়া, ক্ষতস্থানে অবশ অনুভূত হওয়া,
- শরীরের শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ু ও মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়লে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসকষ্ট দেখা যায়,
- শেষ পর্যন্ত অবধারিতভাবে মৃত্যুবরণ করেন।
জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ কত দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়?
সাধারণত আক্রান্ত প্রাণী সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ানোর ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে। তবে আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে এক সাপ্তহের মধ্যেই জলাতঙ্ক রোগ দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে একবছরের কিছু বেশি সময়ের পরেও জলাতঙ্ক রোগ দেখা দিতে পারে।
জলাতঙ্ক রোগের ভাইরাসের নাম কি?
র্যাবিস ভাইরাস।
জলাতঙ্ক কি ছোঁয়াচে রোগ?
জলাতঙ্ক ছোঁয়াচে রোগ না। এটা আক্রান্ত প্রাণী বা মানুষের সংস্পর্শে আসলেই বা ছুলেই সংক্রমণ ছড়ায় না তবে, আক্রান্ত ব্যাক্তি/প্রাণীর কামড়/লালা অপর ব্যাক্তি/প্রাণীর খোলা ক্ষতের সংস্পর্শে আসলে ছড়াবে।
জলাতঙ্ক কি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়?
জলাতঙ্ক মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে কয়েকটি উপায়ে:
- জলাতঙ্কে আক্রান্ত ব্যাক্তির রক্ত কোনো সুস্থ ব্যাক্তির শরীরে দিলে,
- আক্রান্ত ব্যাক্তির কোনো অঙ্গ প্রতিস্থাপন করলে,
- আক্রান্ত ব্যাক্তি কামড়ে দিলে।
জলাতঙ্ক রোগের পরীক্ষা:
ফ্লুরোসেন্ট অ্যান্টিবডি টেস্ট করার মাধ্যমে জলাতঙ্ক রোগ হয়েছে কিনা জানা যায়।
জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেন কে?
লুই পাস্তুর (ফরাসি অণুজীববিজ্ঞানী ও রসায়নবিদ) জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেন ১৮৮৫ সালে।
জলাতঙ্ক রোগের টিকার মেয়াদ:
জলাতঙ্ক রোগের টিকার মেয়াদের ভিন্নতা রয়েছে। টিকাভেদে মেয়াদ ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। সঠিক মেয়াদ জানতে টিকা প্রদানকারী ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
পূর্বে টিকা নেননি এমন রোগীর জন্য বাহুর পেশিতে ০, ৩, ৭, ১৪ এবং ২৮ (ঐচ্ছিক) তম দিন টিকা নিতে হবে। শিশুদেরও একই ডোজ , একই নিয়ম। এক বছরের মধ্যে আবার আক্রান্ত হলে ১টি টিকা, ৫ বছরের মধ্যে আক্রান্ত হলে ২টি টিকা (০,৩য় দিন) এবং এর পরে আক্রান্ত হলে আবার সবগুলো টিকা নিতে হবে।
জলাতঙ্ক রোগের ওষুধ: জলাতঙ্ক রোগের জন্য টিকা ব্যাতীত অন্য কোনো ঔষধ নেই। নিকটস্হ সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে জলাতঙ্ক রোগের টিকা দেয়া হয়। আক্রমণ, ক্ষত, বয়সের উপর ভিত্তি করে এই টিকার ৫ টি ডোজ দেয়া হয়ে থাকে।
বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ
সাধারণত বাসায় পোশা বেড়ালের জলাতঙ্ক রোগ হয়না, তবে বাহিরের বেড়াল, কুকুর, বাদুর ইত্যাদির সাথে মারামারি করায় আক্রান্ত হলে নিম্নের লক্ষণ দেখা দিতে পারে:
- গোঙড়ানো বা ভিন্নস্বরে ডাকা।
- মুখ দিয়ে লালা ঝরা।
- ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া।
- পানি পান বন্ধ করে দেওয়া।
- জ্বর আসা কিংবা প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া।
- হটাৎ অস্বাভাবিক পাগলের মত আচরণ করা।
- হিংস্র হয়ে ওঠা বা কামড় দিতে চাওয়া।
বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের ভ্যাকসিন
Rabisin vaccine বিড়ালকে জলাতঙ্ক (rabies) রোগ থেকে রক্ষা করে। এটি ৩ বছর, ১বছর, ৬মাস বিভিন্ন মেয়াদী হয়ে থাকে। বিড়ালের ভ্যাক্সিনের মূ্ল্য ৩০০-৫০০টাকা (ভ্যাক্সিনের কার্যকাল বা মেয়াদের উপর ভিত্তি করে দাম কম বেশি ্হয়ে থাকে)
বিড়ালের আচরে কি রোগ হয়?
আচরের পরিমাণের উপর নির্ভর করবে:
- বিড়ালের আচরে যদি কোনো ক্ষত না হয় বা রক্ত বের না হয় তাহলে সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন, কোনো সমস্যা হবেনা।
- আচরে যদি চামড়া ছুলে যায় কিন্তু কোনো রক্ত না বের হয় তাহলে কমপক্ষে ১০ থেকে ১০ মিনিট ক্ষারযুক্ত সাবান পানি দিয়ে ধৌত করুন, তাহলে কোনো সমস্যা হবার ভয় থাকবেনা।
- কিন্তু আচড়ে যদি ক্ষত হয় এবং রক্ত বের হয় তাহলে দ্রুত ক্ষারযুক্ত সাবান বা ডিটার্জেন্ট দিয়ে কমপক্ষে ৩০ মিনিট ঘৌত করুন এবং ডাক্তারের পরামর্ষ নিন, এক্ষেত্রে ২৪ ঘন্টার মধ্যো টিকা নিতে হতে পারে।
বিড়াল কামড়ালে কত দিনের মধ্যে টিকা দিতে হয়?
বিড়াল কামড়ালে ২৪ ঘন্টার মধ্যো টিকা দেয়া উচিৎ। কোনো কারণে বিলম্ব হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
কুকুরের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ:
অত্যধিক লালা নিঃসরণ, গিলতে অসুবিধা, গিলতে অসুবিধার কারণে পানির ভয়, উদ্বেগ, বিভ্রান্তি, অনিদ্রা এমনকি আংশিক পক্ষাঘাত এবং কখনও কখনও কোমার মতো লক্ষণগুলি জলাতঙ্কের ইঙ্গিত দেয়। শব্দ, আলো এবং ঠান্ডা বাতাসের ভয় (এরোফোবিয়া) দেখা যায়।
কুকুর কামড়ালে কত দিনের মধ্যে জলাতঙ্ক রোগ হয়?
কুকুরের শরীরে যদি জলাতঙ্ক রোগ বিস্তার লাভ করে থাকে এবং কামড়ানোর পরিমাণ বা ক্ষত বেশি হলে ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। ক্ষতের পরিমাণ ও আরো কিছু কারণে ১ মাস থেকে ১ বছরো লাগতে পারে জলাতঙ্কের লক্ষণ প্রকাশ পেতে, এজন্য কুকুর কামড়ালে অবশ্যই টিকা নেয়া জরুরি।
কুকুরের লালা মানুষের পেটে গেলে কি হয়?
কুকুরের লালায় ক্যাপনোসাইটোফাগা ক্যানিমরসাস নামক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থাকে। এই ব্যাকটেরিয়া যদি মানব শরীরে প্রবেশ করে, তাহলে যে কোনও মুহূর্তেই শরীরে বাসা বাঁধতে পারে মারাত্মক রোগ।
কুকুরের জলাতঙ্ক রোগের টিকা কে আবিষ্কার করেন?
লুই পাস্তুর
কুকুরের জলাতঙ্ক রোগের টিকার নাম কি?
— জলাতঙ্ক রোগের টিকা (Rabies Vaccine) - HEP and LEP
বাচ্চা কুকুর কামড়ালে কি ভ্যাকসিন দিতে হয়?
— বাচ্চা কুকুর কিংবা বাচ্চা বিড়াল কামড়ালেও টিকা দিতে হবে। তবে বাচ্চাটি যদি আপনার বাড়ির পোষা হয় আর আপনি শতভাগ নিশ্চিত হন উক্ত বাচ্চা কুকুরের মায়ের এবং বাবার জলাতঙ্ক রোগের টিকা দেয়া ছিল এবং টিকা দেয়ার পর অন্য কোনো কুকুর, শেয়াল বা কোনো মাংসাশি প্রাণীর সাথে কামড়া কামড়ি করেনি তাহলে টিকা না নিলেও সমস্যা নেই।
পাগলা কুকুর কামড়ালে কি হয়?
পাগলা কুকুর কামড়ালে শতভাগ সম্ভাবণা থাকে জলাতঙ্ক রোগ হওয়ার। কারণ কুকুর জলাতঙ্কে আক্রান্ত হওয়ার কারণেই সবচেয়ে বেশি পাগলা হয়ে থাকে।
কুকুরে কামড়ানো ছাগল কি খাওয়া যায়?
কুকুর কামড়ানোর সাথে সাথে যদি জবাই করতে পারেন, তাহলে কামড়ানো অংশটুকু ফেলে দিয়ে খেতে পারবেন। অন্যথায় ছাগলকে জলাতঙ্ক রোগের ইনজেকশন দিতে হবে এরপর নির্দিষ্ট সময় পার হবার পর উক্ত ছাগল বা পশুর গোস্ত খাওয়া যাবে।
ছাগলের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ কি কি?
ছাগলের জলাতঙ্ক রোগের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত লক্ষণ দেখা যায়:
- ছাগলের কান সজাগ ও চোখ বড় করে রাখে৷
- মুখ দিয়ে প্রচুর লালা ঝরে৷
- পানি পিপাসা হয়, তবে পান করতে পারে না৷
- ভীষণভাবে অশান্ত হয়ে উঠে।
- আটকে রাখা যায় না, ছোটাছুটি করে।
- সামনে যা পায় তাই কামড়ানোর চেষ্টা করে৷
- আক্রান্ত ছাগল পরিশেষে নিস্তেজ হয়ে মারা যায়৷
ছাগলকে কুকুর কামড়ালে কি ভ্যাকসিন দিতে হয়?
— ছাগলকে কুকুর কামড়ালে অবশ্যই ভ্যাকসিন দিতে হবে, নতুবা জলাতঙ্কে আক্তান্ত হতে পারে।
কুকুর বিড়াল, গরু, ছাগলের জলাতঙ্ক রোগের টিকা (Rabies Vaccine):
জলাতঙ্কের জন্য দুই ধরনের টিকা পাওয়া যায়, যথা: HEP and LEP। জলাতঙ্ক রোগের টিকা ভায়ালে বা এম্পুলে হিমশুষ্ক অবস্থায় থাকে। ভায়ালের টিকা ৩ মিলি বিশুদ্ধ (Distilled water) পানিতে মিশিয়ে সম্পূর্ণ টিকা মাংসপেশীতে ইনজেকশন করতে হয়। উল্লেখ্য, HEP (GBP Bwc) টিকা বিশুদ্ধ পানিতে মিশিয়ে ১.৫ মিলি পরিমাণ গরু ও মহিষের ৬ মাস বয়সে মাংসপেশীতে ইনজেকশন করতে হয়। LEP (GI Bwc) কুকুরের ৩ মাস বয়সে প্রথম এবং প্রতি বছর একই নিয়মে এ টিকা (৩.০ মিলি) দিতে হয়। এছাড়াও পশুকে কুকুরে কামড়ানোর পরে পোস্ট এক্সপোসার ভ্যাকসিন এআরভি (Anti Rabies vaccine/ ARV) দিতে হয়। বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির র্যাবিসিন (Rabisin) ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। মাত্রা হলো- ১ম দিনে ৪ মিলি ৪ স্থানে ১ মিলি করে, ৭ম দিনে ৩ মিলি ৩ স্থানে ১ মিলি করে এবং ২১তম দিনে ৩ স্থানে ১ মিলি করে ৩ মিলি মাংসে দিতে হয়।